Uncategorized

সংগ্রামী ছাত্র-জনতার প্রতি আহ্বান-

কোটাসংস্কার আন্দোলন বিজয়ী হয়েছে, কিন্তু রক্তের ঋণ শোধ হয় নাই

গণহত্যাকারী খুনী হাসিনাফ্যাসিবাদ উচ্ছেদের জন্য লড়াই কর!

 

(২২ জুলাই ২০২৪)

 

১৬ জুলাই থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত দিন ধরে ধাপে ধাপে এগিয়ে ছাত্রসমাজের যে আন্দোলন ব্যাপক জনগণের গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছে তাকে হাসিনাআওয়ামীভারত ফ্যাসিবাদীরা রক্তের সাগরে ডুবিয়ে দমন করেছে। কিন্তু পাশাপাশি তারা ছাত্রসমাজের ন্যায্য দাবির কাছে নতিস্বীকারেও বাধ্য হয়েছে। ফলে ছাত্রজনতার এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অর্জিত হয়েছে এক বিরাট বিজয়। একইসাথে আন্দোলনের সীমাবদ্ধতায় হাসিনাফ্যাসিবাদ আপাতত টিকে গেছে। এভাবে আন্দোলন প্রকৃত রাজনৈতিক সফলতা অর্জনে ব্যর্থও হয়েছে।

প্রায় দুই শত প্রাণ স্বল্প সময়ে ফ্যাসিস্টরা কেড়ে নিয়েছে। হাজারের ঊর্ধ্বে ছাত্রতরুণ, পুলিশবিজিবিসেনাবাহিনী লীগসন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়েছে। যাদের অনেকেই হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করছে। হত্যার অভিযান এখনো চলছে। যাতে শরীক হয়েছে ছাত্রলীগসহ আওয়ামী ঘরানার সন্ত্রাসী, পেটোয়া পুলিশ্যাব এবং শেষমেশ সেনাবাহিনী। রাষ্ট্রযন্ত্র অতি নৃশংসভাবে আন্দোলনকে দমন করেছে। দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম ছাত্রজনতার রাস্তার প্রতিরোধ দমনে হেলিকপ্টার থেকে সেনাবাহিনী গুলি করেছে, টিয়ারগ্যাস সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে। তারা গুলি করেছে মিছিলের উপর। সরাসরি গুলি করে হত্যা করেছে রংপুরে শহিদ আবু সাইদকে, যিনি অকুতোভয়ে বুক চিতিয়ে দিয়েছিলেন পুলিশের উদ্যত রাইফেলের সামনে।

ক্ষমতা হারানোর ভয়ে হাসিনাআওয়ামী ফ্যাসিবাদীরা কারফিউ দিয়ে আন্দোলনকে ঘরে বন্দি করেছে। ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে মিডিয়াগুলোর খবর সরবরাহকে সেন্সর করে তাদের ফ্যাসিবাদী একতরফা মিথ্যাপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলনকারী নেতাদের মাঝে ভাঙন সৃষ্টির ইন্ধন দিয়েছে। তাদেরকে গুম করেছে, গ্রেফতার করেছে, বা ভয়ভীতি দেখিয়ে দমন করেছে করছে। তারা প্রথম থেকেই বিএনপিজামাতের জুজুর ভয় দেখাচ্ছে। ছাত্রজনতার বীরত্ব লড়াইয়ের কাছে নিজেদের পরাজয়কে এভাবে তারা লুকাতে চাচ্ছে। এবং যেকোনো উপায়ে নিজেদের ফ্যাসিবাদী ক্ষমতাকে রক্ষার অপচেষ্টা করে চলেছে। ইতিমধ্যেই তারা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলাহামলা শুরু করেছে। যেকোনো বিরোধীকে গ্রেফতার করছে। যা আগামীতে তারা আরো বাড়াবে। পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই বড় ধরনের সন্ত্রাসী অভিযান পরিচালনা শুরু হয়েছে।

 

* তথাপি সরকার এখনো নিজ পতনের ভয়ে কাঁপছে। তাদের নেতাদের গলাবাজি কমে এসেছে। তাদের মুখ শুকিয়ে গেছে। তাদের অনেকে বিদেশে পালিয়ে যাবার পথ খোলা রাখছে। এখনো পর্যন্ত শুধু ভারতের সমর্থনে সেনাআমলাদের অস্ত্রের জোরেই তারা ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু এরাও বিপদ বেশি দেখলে হাসিনাকে বর্জন করেতৃতীয় শক্তি ক্ষমতা আনতে পারে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ তাদের গুটিকয় দালাল ব্যতীত সকল বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ব্যক্তি সরকারের পতন চাইছে। সকলেই দেখেছেন যে, এই সরকারের হাতপাআকণ্ঠ নিমজ্জিত ছাত্রজনতার রক্তে। এরা প্রতারক, ভন্ড মিথ্যুক। এরা আপামর ছাত্রজনতার শত্রু।

এতো বেশি ঘৃণীত বর্জিত হওয়া সত্ত্বেও এই ফ্যাসিবাদী সরকার কেন টিকে থাকতে পারছে? এর একটা কারণ হলো, এদের হাতে রয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতাÑ পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী এবং তাদেরকে প্রত্যক্ষ মদদ দিয়ে চলছে ভারতের সম্প্রসারণবাদীরা, হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট মোদি সরকার। সেই সাথে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীরাও। অন্য কারণটি হলো, কোটাবিরোধী আন্দোলন এযাবত কালের ছাত্রআন্দোলনে অপরিসীম বীরত্ব দেখালেও তা ছিল রাজনৈতিক লক্ষ্যবিহীন। তারা নিজেরাই একে বলেছেঅরাজনৈতিকআন্দোলন। একটি অরাজনৈতিক আন্দোলন হাসিনার মতো ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটাতে পারে না। ফলে সমাজের আর সব সংগ্রামী শ্রেণি বিশেষত নগরের বিশাল শ্রমিক শ্রেণির অংশ গ্রহণ থেকে এটা ছিল বিরাটভাবে বঞ্চিত। ছাত্র সমাজের আন্দোলনের সাথে নাগরিক শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন যুক্ত হলে সরকার এতোদিনে ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হতো। হাসিনাসহ বর্বর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী নেতাদের জনগণ পায়ের নিচে পিষে ফেলতো।

তথাপি আন্দোলনে চরমভাবে ক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। তারা সন্ত্রাসী ছাত্রলীগকে বহু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িকভাবে হলেও উচ্ছেদ করেছে, এই সরকারি গুন্ডাদের সশস্ত্র হামলাকে প্রতিরোধ করে তাদের পাল্টা প্রচমার দিয়েছে, রাস্তার আন্দোলনের উপর সশস্ত্র হামলাকারী লীগওয়ালাদেরকে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিয়েছে, প্রচভাবে ঘৃণীত নেতাদেরকে পিটুনি দিয়েছে, আন্দোলনকারীদের মিছিলে গুলি বর্ষণকারী গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের পিএসকে মেরে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছে, কোথাও বা দুএকটি পুলিশকে ধরে মেরে ঝুলিয়ে রেখেছে। তারা অসংখ্য থানা পুলিশপোস্টে হামলা করে পুড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি নরসিংদী কারাগার ভেঙ্গে সমস্ত বন্দিকে মুক্ত করেছে এবং সেখানকার প্রায় খানেক অস্ত্র লুট করেছে। এগুলো কোনো পরিকল্পিত কেন্দ্রীভূত নেতৃত্বে না ঘটলেও জনগণের প্রচক্ষোভের এই স্বতঃস্ফূর্ত বিষ্ফোরণে ফ্যাসিবাদীরা তো বটেই, গোটা শাসকশ্রেণি স্তম্ভিত হয়ে গেছে। জনতার শক্তির সামনে তারা অসহায় হয়ে পড়েছে, যদিও খুবই সাময়িকভাবে।

প্রায় সারা দেশের ফ্যাসিবাদী শাসনকে কিছু সময়ের জন্য হলেও এই উত্থান অচল করে দিয়েছে।

 

এই আন্দোলন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কতটা বর্বর নিপীড়ক ফ্যাসিবাদীরা হতে পারে। এটা ছিল শুধু ছাত্রদের একটি খুবই যৌক্তিক দাবিকেন্দ্রিক আন্দোলন। তাহলে এদের ফ্যাসিবাদী শাসন উচ্ছেদের সংগ্রামকে তারা কতটা নির্মমভাবে মোকাবেলা করতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

এদেশের ইতিহাসে কখনো গণআন্দোলনগণঅভ্যুত্থানে জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা হয়নি। কখনো কখনো সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেও, এবং জনগণের কিছু দাবি মেনে নিতে বাধ্য হলেও, শাসকশ্রেণিরই অন্যরা সে স্থান দখল করেছে, যেমন৬৯ বা৯০ ঘটেছিল। এর কারণ ছিল, জনগণের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের রাজনৈতিক কর্মসূচি দ্বারা এসব আন্দোলন সজ্জিত ছিল না। শাসকশ্রেণির হাতে অস্ত্র রয়েছে, তাদের হরেকরকম বাহিনী আছে, যা জনগণের এসব রাজনৈতিক শক্তির কাছে ছিল না। সে কারণে আমাদের সর্বহারা পার্টি থেকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বলে থাকি যে, জনগণকে অবশ্যই অস্ত্র ধারণ করতে হবে, নিজেদের বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। এবং সহিংস পথেই এই বর্বর ফ্যাসিবাদী শক্তি তাদের রাষ্ট্রযন্ত্রকে পরাস্ত করতে হবে। জনগণের শত্রুদের অস্ত্রের বিরুদ্ধে পাল্টা অস্ত্র ধারণ করা কোনো অপরাধ নয়। শত্রুর আস্তানা ধ্বংস করা বা তাদের মধ্যকার বর্বর বদমাইশদেরকে হত্যা করা কোনো খারাপ কাজ নয়। কিন্তু তাকে হতে হবে পরিকল্পিত এবং রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ। ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদীদের বর্বর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনগণের সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে বিপ্লবী সন্ত্রাস দ্বারা তাদেরকে মোকাবেলা করার।

গ্রামকে ভিত্তি করে গেরিলা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গণযুদ্ধ বিকশিত করা এবং শ্রমিককৃষকমধ্যবিত্তের একটি নয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই হলো জনগণের প্রকৃত মুক্তির পথ। গ্রামকেন্দ্রিক এমন গণযুদ্ধের সাথে গণআন্দোলনগণঅভ্যুত্থানকে যুক্ত করতে হবে। গণযুদ্ধের ভিত্তির উপর যে নগরকেন্দ্রিক গণআন্দোলনগণঅভ্যুত্থান গড়ে উঠবে, শুধু সেটাই জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।

 

কিন্তু সেটা এক দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম। সেজন্য বিবিধ ধরনের গণআন্দোলনকে বসিয়ে রাখা চলে না; তা বসে থাকবেও না। এছাড়া ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শুধু শ্রমিককৃষকই নয়, সমাজের সর্বস্তরের জনগণ এমনকি বুর্জোয়াদেরও একাংশ সংগ্রাম করছেন। এবারকার আন্দোলনে সেটাই দেখা গেছে, যা চলমান।

তাই, চলমান গণআন্দোলনকে অব্যাহত রাখতে হবে এবং ফ্যাসিবাদ উচ্ছেদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তাকে পরিচালিত করতে হবে। যাতে শ্রমিক কৃষকদেরকে সামিল করতে হবে, বিশেষত নগরের আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণিকে। ফ্যাসিবাদ উচ্ছেদ করে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজ রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে কর্মসূচি সামনে আনতে হবে। সকল বিপ্লবী, গণতান্ত্রিক, বামপন্থি প্রগতিশীল শক্তি এবং রাজনৈতিক দলকে আজ সে লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

 

আমরা সংগ্রামী ছাত্রসমাজকে আহ্বান জানাই, মাঠের লড়াকু সৈনিকদের প্রতি আহ্বান জানাইÑ আপনারা তথাকথিতঅরাজনৈতিকবোলচালের বিভ্রান্তিকে ঝেড়ে ফেলুন। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ আপনাদের দফা দাবি এখনো মেনে নেবে না। তারা কোটাসংস্কার করে কিছুটা পিছু হটে নিজেদের গদিকে সুরক্ষিত করার কৌশল নিয়েছে মাত্র। তারা আন্দোলনের অগ্রসেনাদেরকে ছেড়ে দেবে না। তারা তাদের ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী ছাত্রলীগ প্রতিহিংসার অস্ত্র শান দিচ্ছে। আপনাদেরকেও আপনাদের অস্ত্র শান দিতে হবে। সে অস্ত্র হলো রাজনৈতিক কর্মসূচি, যার সূচিমুখ এখন হলো হাসিনাআওয়ামী ফ্যাসিবাদকে উচ্ছেদ করা। এটাই পথ দফা দাবি পূরণ করার। শহিদের স্বপ্ন পূরণের। শহিদ পরিবারগুলোর প্রতি আপনাদের কর্তব্য পূরণের।

 

* মার্কসবাদলেনিনবাদমাওবাদ জিন্দাবাদ!

* সাম্রাজ্যবাদ, ভারত বিদেশি শোষণনিয়ন্ত্রণ মুক্ত প্রকৃত স্বাধীন গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা কর!

* কৃষিবিপ্লব জিন্দাবাদ!

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি