গণযুদ্ধতত্ত্বভারত

কোভিড ১৯: ভাইরাসটি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, এর সামাজিক উৎসও ততটাই

কোভিডের জেরে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে উন্নত দেশগুলিতে, যেখানে নাকি চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত। অনেকের মাথায় অনেক কারণই আসতে পারে, কিন্তু মূল দোষী হল নয়া উদারনৈতিক কর্মসূচি- যা জনস্বাস্থ্য পরিষেবার হাঁড়ির হাল করে ছেড়েছে। আমেরিকা ও ইতালিতে বেশি মৃত্যুর প্রধান কারণই হল, যথা সময়ে চিকিৎসা না হওয়া। অনেকের কোনো চিকিৎসাই হয়নি। আমেরিকার গরিব মানুষের বড়ো অংশের কোনো স্বাস্থ্যবিমা নেই (আফ্রিকান-আমেরিকান এবং স্প্যানিশভাষী হিস্প্যানিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ), তাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবাও জোটে না।

একই কথা প্রযোজ্য মধ্যবিত্তের শ্রেণির বেকারদের ক্ষেত্রেও। ফলে, তারা অসুস্থ হলেই দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে পারে না। যখন তারা যেতে বাধ্য হয়, ততদিনে রোগ হাতের বাইরে চলে যায়। চিকিৎসাকর্মীদের হাতে যন্ত্রপাতি কম থাকায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। ট্রাম্প এবং অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা স্বার্থপর দায়িত্বজ্ঞানহীনতার চূড়ান্ত নজির দেখাচ্ছেন। জনগণের স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার চেয়ে তাদের অনেক বেশি আগ্রহ নিয়মমাফিক, মুনাফা প্রসবকারী অর্থনৈতিক কাজকর্মের প্রতি। এর জন্যও সেখানে মৃত্যুর হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। যে রোগে মাত্র ২ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়, তাতে এই বিশাল সংখ্যক প্রাণ নষ্ট হচ্ছে। উদারনীতিবাদ ও তার জনক পুঁজিবাদের জনবিরোধী চরিত্র ও অদক্ষতা এর ফলে খুল্লমখুল্লা হয়ে পড়েছে।

এইসব অপরাধীদের ভূমিকা সেখানেই শেষ নয়। একদল বলে চলেছে, এই রোগসৃষ্টিকারী জীবানুর আবির্ভাব নেহাতই ঘটনাচক্র, কেউ একে থামাতে পারবে না। কেউ কেউ মনে করছেন, করোনা মোকাবিলায় যে সব পদক্ষেপ করা হয়েছে, সেগুলোর খামতি নিয়ে বড়োজোর আলোচনা করা যেতে পারে। কেউ বা বলছেন, এ হল প্রকৃতির প্রতিশোধ। আমাদের শাস্তি দেওয়ার কোনো অলৌকিক ক্ষমতা প্রকৃতির নেই। ভবিষ্যতেও সে এমন কিছু করবে না। যদিও, এঙ্গেলসের কথা অনুযায়ী, সেই ধরনের কিছু একটা হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে।

এঙ্গেলস লিখেছিলেন, মানুষ প্রকৃতিকে জয় করেছে ভেবে গর্ব করলেও, শেষে, প্রকৃতি তাকে তীব্র আঘাত করে বুঝিয়ে দেবে, কে আসল প্রভু। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের কৃতকর্মের ফলাফলের কথা বোঝাতে চেয়েছিলেন। এই কথাগুলো পুঁজিবাদের দাবির অন্তঃসারশূন্যতাকেই প্রকাশ করে, পাশাপাশি ইঙ্গিত করে তাদের ধ্বংসাত্মক উন্নয়নের নীতির দিকেও।
আজকের করোনা-অতিমারির উৎস ও বিস্তারের দিকে তাকালেও এটা ভালোমতো দেখা যায়। কেউ কেউ এই বিষয়টাকে জিনগত কারণের ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে বেঁধে রাখতে চাইছেন। এইসব বলে, তারা সাম্রাজ্যবাদী সম্পর্কের মধ্যে গোটা দুনিয়ার বাঁধা পড়ে যাওয়ার ফলাফলকে লুকোতে চাইছেন। এই বিষয়টি ‘মান্থলি রিভিউ’ পত্রিকার মে ইস্যুর প্রধান প্রবন্ধটিতে বৈজ্ঞানিক ভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

প্রবন্ধটি শুরু হয়েছে উহানের মাংসের বাজার থেকে। কিন্তু তা চিনাদের খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে নিজেদের আটকে রাখেনি, সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার পাশ্চাত্যের চোখ দিয়ে দেখলে যে খাদ্যাভ্যাসকে ভারী অদ্ভুত লাগে। বরং তাদের প্রবন্ধ, ওই বাজারের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে প্রবেশ করেছে। প্রবন্ধটি শুরু হয়েছে এভাবে, “উহানের সবচেয়ে বড়ো বাজারে চিনের চিরায়ত মাংসগুলির পাশে কীভাবে বহিরাগত খাদ্যসম্ভার নিজেদের বেসাতির জায়গা করে নিল”?

প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে, “দুনিয়া জুড়েই পশুপাখির মাংস একটি অত্যন্ত সংগঠিত ক্ষেত্র, শিল্প উৎপাদন যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তারাই এই ক্ষেত্রটিও পান্ডা। মাছের বাজারের সঙ্গে এর কোনো তুলনাই চলে না”। উহানের বাজার থেকে একটি শৃঙ্খল শুরু হয়ে পৌঁছে যায় এমন জায়গায়, যেখানে বহিরাগত ও চিরায়ত খাদ্য প্রায় একই সঙ্গে তৈরি হয়। দুই ধরনের খাদ্যের পরস্পরের সংষ্পর্শে আসার সম্ভাবনা সেখানে ব্যাপক। সেখান থেকে একাধিক বাণিজ্য/পরিবহণের শৃঙ্খলের মধ্যে দিয়ে সেই খাবার পৌঁছে যায় দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ও বড়ো শহরে। এভাবেই করোনাভাইরাস সেখানে আসে এবং এই পথেই পর্যটন করে। ঠিক যেভাবে এর আগে সার্স এসেছিল।

জনসন অ্যান্ড জনসনের মতো কয়েকটি বহুজাতিক সংস্থা, আগামী দিনে কোথায় কোথায় নতুন জীবানু কোষ পাওয়া যেতে পারে, তার একটি মানচিত্র তৈরি করেছে। যে ভৌগলিক দৃষ্টিভঙ্গি তারা গ্রহণ করেছে, তাতে তৃতীয় বিশ্বের দিকেই নজর দেওয়া হয়েছে। মান্থলি রিভিউ-র প্রবন্ধে এর সমালোচনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, “উৎস অঞ্চলের দিকে নজর দিতে গিয়ে আন্তর্জাতিক আর্থিক শক্তিগুলির সম্পর্ককে উপেক্ষা করা হয়েছে, যা কিনা মহামারিবিদ্যার ভিত্তি”। এই সম্পর্কগুলির দিকে নজর দিলে দেখব, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি নয়, বরং বিশ্বপুঁজির তিনটি প্রধান ক্ষেত্র নিউইয়র্ক, লন্ডন এবং হংকং-ই হল সবচেয়ে বিপজ্জনক হটস্পট। এই নতুন ভাইরাসগুলি বন্যপ্রাণী থেকে সরাসরি মানুষের মধ্যে ছড়াতে সক্ষম। পুঁজিবাদের সীমান্তে আজকাল তেমনটাই ঘটছে। অর্থাৎ টিকে থাকা বনাঞ্চলগুলিতে। অরণ্য ধ্বংস করার ফলে রোগবহনকারী বন্যপ্রাণীদের থাকার জায়গা নষ্ট হচ্ছে। ফলে তা ছড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। জনবিরল অরণ্য থেকে যাত্রা শুরু করে রোগজীবাণু বিশ্বায়নের হাত ধরে স্থানকালের সীমানা পেরিয়ে গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে মাত্র দিনকয়েকের মধ্যে।

প্রবন্ধটির সারাংশ এভাবে লেখা যেতে পারে- যেসব ভাইরাসগুলি কর্কটক্রান্তীয় অরণ্যের জটিল পরিবেশের মধ্যে আবদ্ধ ছিল, সেগুলি অরণ্য ধ্বংস, জনস্বাস্থ্যের অভাব ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের হাত ধরে মূলস্রোতে ঢুকে পড়েছে।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, বিশ্বায়ন ও নয়া উদারনৈতিক নীতির ফলে ব্যাপক মানুষের জীবন-জীবিকা ও পরিবেশের যে পরিবর্তন হয়েছে, তার ফলেই তৈরি হয়েছে বর্তমান বিপর্যয়। এর সমাধানের প্রাথমিক শর্তই হল সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার ধ্বংসসাধন এবং সাম্যবাদের পথে যাত্রার সাফল্য। মানবজীবনে মানবিকতার ছোঁয়া আনতে এবং পরিবেশকে বাঁচাতে(বন্যপ্রাণ যার অঙ্গ)এটাই একমাত্র পথ।

বস্তুত, কিউবা এবং ভিয়েতনাম উভয়েই সেই কথা বলছে। তারা কেউই আজ সমাজতান্ত্রিক দেশ নয়। পুঁজিবাদের পুনর্জীবনের ফলে দুটি দেশই আজ কোনো না কোনো ভাবে সাম্রাজ্যবাদী সম্পর্কে আবদ্ধ। চিন মজুরি বৃদ্ধি করায় আন্তর্জাতিক একচেটিয়া পুঁজি ভিয়েতনামে সরে গেছে। যাইহোক না কেন, সমাজতান্ত্রিক যুগের কিছু অবশেষ এখনও সেই দেশগুলিতে রয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য এখনও সেখানে মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র। এমন বেশ কিছু সংগঠন আছে, যারা স্বেচ্ছায় প্রচুর পরিষেবা দিয়ে থাকে। অতিমারির মোকাবিলায় এই দেশগুলি এ সবের সুবিধা পেয়েছে। আজকের সাম্রাজ্যবাদী দেশ চিনকেও কীভাবে ফেলে আসা সমাজতান্ত্রিক যুগ সাহায্য করেছে, সেটাও সাদা চোখে দেখা যাচ্ছে। কেরালায় ব্যাপক গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রগুলিকে রক্ষা করা গেছে বলেই, তা ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলির তুলনায় ভালো ভাবে করোনার মোকাবিলা করতে পেরেছে। অন্যদিকে, জ্বর বা সর্দি নিয়ে কোনো রোগী বড়ো বেসরকারি হাসপাতালে গেলে, তারা অমানবিক ভাবে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে।

এটা আর কতদিন চলে, তা দেখতে হবে। করোনার প্রভাবে নিশ্চিত ভাবেই জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার পুনর্জাগরণ ঘটবে। কিন্তু সেটা পুঁজির নিয়মের বাইরে। তাই এতে বাধা আসবে। পুঁজির স্মরণশক্তি দুর্বল। মুনাফার আশায় রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের আবার বেসরকারিকরণের চক্করে ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা যথেষ্টই রয়েছে। যদি জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকেও যায়, সেটাও পুঁজি তথ্য ভাণ্ডার হিসেবে ব্যাপক ভাবে কাজে লাগাবে। ‘স্প্রিংলার চুক্তি’তে সেটা আমরা দেখেছি (বর্তমান অতিমারির সময় একটি মার্কিন তথ্য বিশ্লেষক সংস্থার সঙ্গে সিপিএম-নেতৃত্বাধীন কেরল সরকার ওই চুক্তি করে)। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারকে উড়িয়ে দিয়ে ওই চুক্তি অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য পরিষেবার নাম করে সংগ্রহ করা তথ্য ওষুধ সংস্থা, বিমা সংস্থা ও অন্যদের কাঁচা মাল হিসেবে কাজে লাগতে পারে। এটা একটা নতুন, আরও বিপজ্জনক ধরনের বেসরকারিকরণ। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের আড়ালে লুকিয়ে থেকে, সম্পূর্ণ পরোক্ষ ভাবে পুঁজির তার লাভের গুড় খাবে। মোদি যে স্বাস্থ্য অ্যাপের বিপণন করছে, সেটিও একই কাজ করছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র থাকাটাই সব নয়। সেটা যাতে অবশ্যই জনগণকে সেবা করে, তা দেখতে হবে। সেটাকে অবশ্যই এমন এক সামাজিক রূপান্তরের অংশ হতে হবে, যেটা অর্থনীতি ও পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারির বিভেদ মুছে দেবে। যেটা সমাজতন্ত্রের ছায়া হলে চলবে না, নিরন্তর বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে সাম্যবাদের পথে যাত্রা হিসেবেই তা তৈরি হতে হবে। সেই বিপ্লব কমিউনিস্ট মতাদর্শ বর্তমানে যে উচ্চতায় পৌঁছেছে, তার দ্বারাই পরিচালিত হতে হবে।

Translation: RSYM